দেশের বাজারে কমেছে নির্মাণ-সামগ্রী রড ও সিমেন্টের দাম। গত ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর থেকেই বড় উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ স্তিমিত হয়ে পড়েছে। একইসঙ্গে এ বছরই দেশের বিভিন্ন জেলায় বন্যার কারণে দীর্ঘদিন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় বেসরকারি এবং ব্যক্তিপর্যায়ের নির্মাণকাজও ধীরগতিতে এগোচ্ছে। এতে চাহিদা ও বিক্রি কমে নির্মাণকাজের প্রধান উপকরণ রড ও সিমেন্ট ব্যবসায় ধস নেমেছে। ব্যবহারজনিত চাহিদা বৃদ্ধি না পেলে এ খাত ঘুরে দাঁড়াতে সময় লাগবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে নির্মাণকাজে সম্পৃক্তদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
সিমেন্ট ও ইস্পাত খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে সরকারের বেশিরভাগ উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ বন্ধ হওয়ার পাশাপাশি বেসরকারি আবাসন শিল্পেও স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে রড ও সিমেন্টের বাজারে।
উদ্যোক্তারা আরও জানান, সরকার পরিবর্তনের পর নির্মাণকাজের সঙ্গে জড়িত বেশিরভাগ ঠিকাদার গা-ঢাকা দিয়েছেন। অপরদিকে ব্যাংকের ঋণের বিপরীতে সুদের হার বেড়েছে, বেড়েছে উৎপাদন ব্যয়ও। কিন্তু চাহিদা কমে যাওয়ায় বাড়তি ব্যয় সমন্বয় করা যাচ্ছে না। শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে কোম্পানিগুলোকে অতিরিক্ত ৬০-৭০ শতাংশ মূলধন জোগানের অনুরোধ করছেন এই দুই শিল্পের সঙ্গে জড়িতরা।
অবকাঠামো উন্নয়নের অন্যতম উপকরণ সিমেন্ট। জানা গেছে, সিমেন্ট খাতের উৎপাদন সরকারি নির্মাণ প্রকল্পের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। দেশের বিভিন্ন মেগা উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ প্রায় শেষ। যেসব প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে; সেগুলো গত ৫ আগস্টের পর বন্ধ রয়েছে। যার সরাসরি প্রভাব পড়েছে সিমেন্ট খাতে। বিশ্ববাজার থেকে আমদানি, ডলার সংকটসহ বিভিন্ন সমস্যা কেটে গেলেও ব্যবহারজনিত চাহিদা বৃদ্ধি না পেলে এ খাতও ঘুরে দাঁড়াতে সময় লাগবে বলে মনে করছেন তারা।
সূত্র জানিয়েছে, অবকাঠামো উন্নয়ন থেমে যাওয়ার আরেক কারণ হচ্ছে স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের বাদ দেওয়ায় সিটি করপোরেশন থেকে শুরু করে উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের উন্নয়নকাজেও স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদ বাতিল করা না হলেও বেশিরভাগ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও মেম্বাররা আড়ালে-আবডালে রয়েছেন। অপরদিকে দেশের চলমান পরিস্থিতি ও ড্যাপের কারণেও আবাসন খাতে বেচাবিক্রি ও নতুন প্রকল্পও কমে গেছে। ফলে রড-সিমেন্টের বিক্রি কমেছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে এ দুই খাতের উদ্যোক্তারা অনিশ্চয়তায় ভুগছেন।
তারা বলছেন, ব্যবসা টিকিয়ে রাখাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ। এ অবস্থায় নতুন বিনিয়োগের কথা ভাবছি না। জানা গেছে, চলতি বছরের মে-জুন মাসে প্রতি টন রডের দাম ছিল ৯০ হাজার টাকার বেশি। বর্তমানে বাজারে ৮৬ হাজার থেকে ৮৭ হাজার টাকা টন দরে রড বিক্রি হচ্ছে। অন্যদিকে মে-জুনের তুলনায় সিমেন্টের দাম বস্তাপ্রতি (৫০ কেজি) ২০-২৫ টাকা কমেছে।
বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএসএমএ) জানায়, দেশে ইস্পাত কারখানা দুই শতাধিক। এর মধ্যে বড় প্রতিষ্ঠান ৪০টি। প্রতিষ্ঠানগুলোর বছরে প্রায় ১ কোটি ১০ লাখ মেট্রিক টন রড উৎপাদনের সক্ষমতা আছে। যদিও দেশে বার্ষিক রডের চাহিদা ৭৫ লাখ টন। এখন পর্যন্ত এই খাতে ৭৫ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ হয়েছে। বছরে লেনদেনের পরিমাণ ৭০ হাজার কোটি টাকা।
বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুসারে, দেশের কোম্পানিগুলোর রড উৎপাদনে সক্ষমতা ১ কোটি ২০ লাখ টন। বছরে সর্বোচ্চ চাহিদা ৬৫ লাখ টন। এর মধ্যে ৬০ শতাংশই ব্যবহার হয় সরকারি উন্নয়ন প্রকল্পে। বাকি ৪০ শতাংশ বেসরকারি ও ব্যক্তিগত অবকাঠামো নির্মাণে ব্যবহার হয়। বর্তমানে চাহিদা কমে ৫০ শতাংশের নিচে নেমে গেছে। সবচেয়ে বেশি চাহিদা কমেছে সরকারি প্রকল্পে। এখানে রডের চাহিদা ২০ শতাংশের নিচে নেমে আসায় দামও ধারাবাহিকভাবে কমছে।
জানা গেছে, গত কয়েক দিনে সিমেন্ট ডিলারদের বিশেষ ছাড় দিচ্ছেন উৎপাদকরা। এতে বস্তাপ্রতি দাম ১০-১৫ টাকা কম রাখতে পারছেন পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতারা। তবে এ অবস্থায় শঙ্কিত সিমেন্ট উৎপাদনকারী উদ্যোক্তারা। নব্বইয়ের দশকেও বাংলাদেশ সিমেন্ট আমদানিনির্ভর ছিল। তবে ওই সময় সিমেন্টের প্রধান কাঁচামাল ক্লিংকারের দাম অস্বাভাবিক কমে যায়।
ধস নেমেছে রড ও সিমেন্টের বাজারেধস নেমেছে রড ও সিমেন্টের বাজারে
তখন সিমেন্ট আমদানির শুল্কও অনেক বেশি ছিল। এ অবস্থায় অনেক বহুজাতিক কোম্পানি এখানে কারখানা স্থাপনের উদ্যোগ নেয়। পরে স্থানীয় কোম্পানিগুলো এ খাতে বিনিয়োগে এগিয়ে আসে। প্রথম দিকে সিমেন্ট উৎপাদনেও অনেক লাভ ছিল। ২০০০ সালের পর এই খাতে বড় পরিবর্তন আসে। তখন বছরে চাহিদা ছিল ২ দশমিক ৫ মিলিয়ন টন, যার ৯০ শতাংশই আমদানি হতো। পরবর্তী কয়েক বছরে দেখা যায়, দেশে সিমেন্ট চাহিদার চেয়ে বেশি উৎপাদন হচ্ছে। ফলে একপর্যায়ে সিমেন্ট আমদানি বন্ধ হয়ে যায়। বর্তমানে দেশে বছরে সিমেন্টের চাহিদা প্রায় ৩৮ মিলিয়ন টন। এতে বোঝা যায়, সরকারি ও বেসরকারি খাতে নির্মাণকাজ অনেক বেড়েছে। নব্বইয়ের দশকে দেশে মাথাপিছু সিমেন্টের ব্যবহার ছিল মাত্র ৩২ কেজি, যা ২০০০ সালে ছিল ৫৫ কেজি এবং বর্তমানে ২২৫ কেজি। ৩৫টি দেশি ও বিদেশি কোম্পানি সিমেন্ট উৎপাদনে রয়েছে।
বিভিন্ন কোম্পানির রডের দাম
বাজারে এখন বিভিন্ন কোম্পানির রড বিক্রি হচ্ছে বিভিন্ন দামে। বাজার ঘুরে দেখা গেছে, চলতি ডিসেম্বরে আকিজ ইস্পাতের প্রতি টন রড বিক্রি হচ্ছে ৯০ হাজার টাকা দরে। একেএস স্টিলের রড ৮৫ হাজার ৫০০ টাকা, আনোয়ার স্টিলের ৮৫ হাজার টাকা, এএসবিআরএম স্টিলের ৮১ হাজার টাকা, বাইজিদ স্টিলের ৮৫ হাজার ৫০০ টাকা, বিএসআই স্টিলের ৮০ হাজার ৭০০ টাকা, বিএসআরআরএম স্টিলের ৮৮ হাজার টাকা, সিএসআরএম স্টিলের ৮১ হাজার ৫০০ টাকা, ঢাকা স্টিলের ৮৭ হাজার টাকা, গোল্ডেন স্টিলের ৮৭ হাজার ৫০০ টাকা, জিপিএইচ স্টিলের ৮৬ হাজার ৫০০ টাকা, হাইটেক স্টিলের ৮০ হাজার ৬০০ টাকা, এইচকেজি স্টিলের ৮২ হাজার টাকা, এইচআরআরএম স্টিলের ৮৫ হাজার টাকা, জেএসআরএম স্টিলের ৭৯ হাজার ৬০০ টাকা, কিং স্টিলের ৮৮ হাজার টাকা, কেআর স্টিলের ৮৮ হাজার ৫০০ টাকা, কেএসএমএল স্টিলের ৮৮ হাজার টাকা, কেএসআরএম স্টিলের ৮৬ হাজার টাকা, মেট্রো স্টিলের ৮৫ হাজার টাকা, এমএসডব্লিউ স্টিলের ৮০ হাজার ৬০০ টাকা, পিএইচপি স্টিলের ৮৫ হাজার ৫০০ টাকা, প্রাইম স্টিলের ৮০ হাজার ৮০০ টাকা, পিএসআরএম স্টিলের ৮০ হাজার ৬০০ টাকা, রহিম স্টিলের ৮৪ হাজার ৫০০ টাকা, আরআরএম স্টিলের ৮৭ হাজার টাকা, আরএসআরএম স্টিলের ৮৫ হাজার টাকা, এস আলম স্টিলের ৮৮ হাজার টাকা, সারম স্টিলের ৮৮ হাজার ৫০০ টাকা, এসএএস স্টিলের ৮৭ হাজার ৬০০ টাকা, এসসিআরএম স্টিলের ৮১ হাজার ৫০০ টাকা, এসএস স্টিলের ৮১ হাজার টাকা, এসএসআরএম স্টিলের ৮১ হাজার টাকা, সুমা স্টিলের ৮১ হাজার ৫০০ টাকা ও জেডএসআরএম স্টিলের রড ৮২ হাজার টাকা টন দরে বিক্রি হচ্ছে।
বিভিন্ন কোম্পানির সিমেন্টের দাম
বাজার ঘুরে দেখা গেছে, চলতি ডিসেম্বরে ৫০ কেজি ওজনের এক বস্তা সিমেন্ট বিক্রি হচ্ছে বিভিন্ন দামে। এর মধ্যে বসুন্ধরা ৪৮৫, শাহ সিমেন্ট ৪৯২, আকিজ সিমেন্ট ও হোলসিম সিমেন্ট ৬৪৫, স্ক্যান মাল্টি সিমেন্ট ৫০৫, বেঙ্গল সিমেন্ট ৪৭৫, ইস্টার্ন সিমেন্ট ৪৬৫, সুপারক্রিট সিমেন্ট ৪৯০, প্রিমিয়ার সিমেন্ট ৪৭৫, স্ক্যান সিমেন্ট ৫২৫, টাইগার সিমেন্ট ৪৮০, লাফার্জ সিমেন্ট ৫২০ ও সেভেন হর্স সিমেন্ট বিক্রি হচ্ছে ৪৬০ টাকা দরে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব সুমন চৌধুরী বলেন, ৫ আগস্টের পর সরকারি প্রকল্পের অনুমোদন কার্যত বন্ধ রয়েছে। চলমান প্রকল্পগুলোর কাজের গতিও শূন্যের কোঠায়। এতে রডের চাহিদা ৫০ শতাংশেরও বেশি কমেছে। সংকটে পড়েছে দেশের ইস্পাত ও সিমেন্ট খাত।
কেএসআরএম গ্রুপের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহরিয়ার জাহান জানান, কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। প্রতি টন রডে ২৪ হাজার টাকা লোকসান দিচ্ছি। এখন ১ টন রড উৎপাদনে খরচ ১ লাখ ১০ হাজার টাকা। অথচ কোম্পানি রড বিক্রি করছে ৮৬ হাজার টাকায়।
বাণিজ্য উপদেষ্টার বক্তব্য
এ প্রসঙ্গে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশির উদ্দিন জানিয়েছেন, রাজনৈতিক কারণে কিছু ঠিকাদার পলাতক। এতে উন্নয়নকাজ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এ ছাড়াও অপ্রয়োজনীয় কিছু প্রকল্প বাদ দেওয়া হচ্ছে। এতে রড-সিমেন্টের কাজ কমে গেছে। এ শিল্পে সৃষ্ট সংকট কীভাবে কাটিয়ে ওঠা যায়, সেসব নিয়ে আলাপ-আলোচনা করছি।
সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন